চাঁদপুরে বাড়ছে তালাক বা বিয়ে বিচ্ছেদ। প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকাটিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব সহজেই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াচ্ছেন নারী-পুরুষসহ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন স্থানে স্বামী-স্ত্রী কিংবা শিক্ষার্থীরা ঘরছাড়া হচ্ছেন। চাঁদপুরের থানাগুলোতে এখনো সহস্রাধিক নিখোঁজ ডায়েরি রয়েছে। বর্তমানে বিয়ে বিচ্ছেদের হারে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না।
চাঁদপুরের ৮ উপজেলায় গেলো এক বছরে বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে ১৪ হাজার ৪৬৫টি। একই সময়ে তালাক বা বিচ্ছেদ হয়েছে ৭ হাজার ৮৯১। সরকারি পরিসংখ্যানে গড়ে দৈনিক তালাক হচ্ছে ২১টি করে। এর মধ্যে নারীরাই বিচ্ছেদের আবেদন করছেন সব থেকে বেশি। বিশেষ করে চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং পরকীয়ার কারণে ঘরছাড়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
এদিকে চাঁদপুরের আদালতে গেলো এক বছরে নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে মামলা বিচারাধীন ছিল ২৭৫৪টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯৮৮টি। যার মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে তালাক বা বিচ্ছেদের মাধ্যমে। অন্যদিকে জেলার বিভিন্ন থানা সূত্রে জানা যায়, পরকীয়াসহ পারিবারিক কারণে ঘরছাড়া সহস্রাধিক নারী-পুরষ। এরমধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে তালাকের বড় কারণ নারী কিংবা পুরুষের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়া, নারী নির্যাতন, বাল্য বিয়ে, পারিবারিক বন্ধনের ঘাটতি ও যৌন অক্ষমতা।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা নাছির পাঠান বলেন, এই উপজেলাটি প্রবাসী অধ্যুষিত। বিয়ের পর পুরুষরা যখন প্রবাসে পাড়ি জমায়, তখন নারীরা একাকিত্ব বোধ করে। ওই সময় স্বামীর পরিবারের সঙ্গে নানা কারণে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। যার কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। তিনি আরও বলেন, আরেকটি বড় কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমানে ফেসবুকের কারণে নতুন করে সম্পর্কে জড়ায় নারী-পুরুষরা। যার কারণে পরিবারের অমতেই অনেকে ঘর ছেড়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু সেই বিয়েটা বেশিদিন টিকে না। চাঁদপুর পৌর এলাকার বাসিন্দা আব্দুল জব্বার বলেন, দেশ ডিজিটাল ও স্মার্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনও কমে গেছে। পরকীয়া ও বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ স্মার্ট ফোন। এখনকার জেনারেশন পরিবারকে সময় দেয় না, যত সময় ব্যয় করে সব স্মার্টফোনে। পরিবার ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলেই তখন আর সংসার টেকে না। বিশেষ করে ফেসবুকের কারণে অনেক সংসার নষ্ট হচ্ছে।
চাঁদপুর কাজী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী সুফিয়ান দেওয়ান বলেন, বিয়ের ক্ষেত্রে সরকার কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। আর কাজীরা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরি করেন এবং জবাবদিহিতা রয়েছে। কিন্তু কোর্টে কোনো জবাবদিহি না থাকায় রোটারির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বাল্যবিবাহ হচ্ছে। অনেক জেলায় রোটারির মাধ্যমে বিবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। চাঁদপুরেও যদি এটি বন্ধ করা যায়, তাহলে অনেক বিবাহ এবং বিচ্ছেদ কমে যাবে।
চাঁদপুর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট শিরিন সুলতানা মুক্তা বলেন, আমাদের কোর্টে যে মামলাগুলো হয়, বিচারক এবং আমরা আপোষের পক্ষে। বিবাহ বিচ্ছেদ যাতে না হয়, সেজন্য আমরা দুই পক্ষের আইনজীবীই একসঙ্গে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বলা চলে মামলার ৮০ ভাগই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) মো. এনামুল হক বলেন, ইদানিং চাঁদপুরে নিখোঁজ এবং ডিভোর্সের সংখ্যা অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। এর অন্যতম কারণ সোশ্যাল মিডিয়া, প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা এবং পারিবারিক বন্ধনের অভাব। স্বামীরা বিদেশে থাকেন, আর যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় সম্পর্কের টানাপোড়ন তৈরি হয়। বিশেষ করে নারীরা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে আবেগ আপ্লুত হয়ে অনেক বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। অনেকে ডিভোর্স দিচ্ছেন আবার অনেকে পরিবার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছেন। এর থেকে বের হওয়ার উপায় আমি মনে করি পারিবারিক মূল্যবোধ ও যৌথ পরিবার ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার সঠিক ব্যবহার করতে হবে।
চাঁদপুর জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুর রকিব বলেন, প্রবাসী পরিবারগুলোতে নিখোঁজ কিংবা বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা একটু বেশি ঘটছে। থানাগুলোতে অধিকাংশ নিখোঁজ মামলাগুলোর মীমাংসা করা হয়। পরকীয়া ও বিবাহবিচ্ছেদ কমাতে হলে সামাজিক সচেতনতা ও পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন